'থ্যাংকলেস জব'


'থ্যাংকলেস জব' আম্পায়ারিংয়ের কাজটা । খুব বিরক্তিকর কিংবা একঘেয়ে বলেও মনে হতে পারে।  ভুল করলেই সৃষ্টি হয় তুমুল বিতর্ক। এমন বোরিং এবং চ্যালেঞ্জিং কাজটাকেই 'উপভোগ্য' করে তুলেছিলেন কিউই আম্পায়ার বিলি বাউডেন।  আম্পায়ারিং দিয়েই এই মানুষটা জায়গা করে নিয়েছেন অসংখ্য ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে।
আম্পায়ারিংয়ের চিরায়ত ভাবগম্ভীর প্রথাকে ভেঙ্গে বাউডেন এনেছিলেন বিনোদনের নতুন এক মাত্রা। তাঁর প্রত্যেকটা আম্পায়ারিং সিগন্যালেই মিশে থাকত মজাকরার এক ধরনের প্রবণতা। ছয়ের সংকেত দিতেন কয়েকধাপে, চারের সংকেত দিতেও ব্যবহার করতেন দুই হাত! বাউডেনের বাউন্ডারি এবং ওভার বাউন্ডারি দেয়ার সিগন্যালের আবার বাহারি নামও আছে। এক হাতের বদলে দুই হাত নেড়ে চারের সংকেত দেয়ার স্টাইলের নাম 'ক্রাম্ব সুইপিং'। আর কয়েকধাপে ভাঁজ করা আঙুলসহ দুই হাত তুলে ছক্কার সংকেত দেবার স্টাইলকে বলা হয় 'ডাবল ক্রুকেড ফিঙ্গার সিক্স ফেজ হপ'
সবচেয়ে বিখ্যাত বোধহয় সেই ক্রুকেড ফিংগারঅর্থাৎ আঙ্গুল বাঁকা করে দেয়া আউটের সংকেত। আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মত নিজের হাতের আঙুলগুলো ইচ্ছামত সোজা কিংবা বাঁকা করতে পারেন না তিনি।
এই ক্রুকেড ফিংগারেরপেছনের ইতিহাসটা অবশ্য মোটেও মজারনয়; বরং আক্ষেপের। ছোটবেলা থেকেই ব্যাটিংটা ভালই করতেন বিলি। বড় ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছাটা তৈরি হয়েছিল তখন থেকেই। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! মাত্র একুশ বছর বয়সেই ধরা পড়ল দুরারোগ্য ব্যাধি রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস (এক ধরনের বাতরোগ)। ক্রিকেটার হবার স্বপ্নটাও বিসর্জন দিতে হয়েছিল তখনই। তবে ক্রিকেট মাঠে ক্রিকেটের সাথেই রয়ে গেলেন বিলি বাউডেন। সেই থাকাটা অবশ্য ক্রিকেটার হিসেবে নয়! তিনি বেছে নিলেন আম্পায়ারিং।
আরথ্রাইটিস তাঁর অস্থি সন্ধিগুলোকে আক্রান্ত করলেও এতটুকুও দমাতে পারেনি ক্রিকেটের প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসাকে। নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনই বদলে দিল সব। পেয়ে গেলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে ম্যাচ পরিচালনা করার সুবর্ণ সুযোগ। এভাবেই মিঃ বাউডেন ধীরে ধীরে আম্পায়ার হিসেবে হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন নিজেকে।
১৯৯৫ সালে হ্যামিল্টনে মাত্র ৩২ বছর বয়সে নিউজিল্যান্ড বনাম শ্রীলঙ্কার মধ্যকার একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ দিয়ে আম্পায়ারিংয়ের জগতে অভিষেক হয়েছিল বিলির। টেস্ট অভিষেক ২০০০ সালে, ঘরের মাঠ অকল্যান্ডে। সেই ম্যাচে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। মজার ব্যাপার হল, বাউডেনের আম্পায়ারিং জীবনের শততম ম্যাচটাও ছিল শ্রীলঙ্কা বনাম নিউজিল্যান্ডের মধ্যে। ভেন্যুও ছিল সেই হ্যামিল্টন।
২০০৩ সালে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বাউডেন। অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যকার ফাইনালে তিনি ছিলেন 'চতুর্থ আম্পায়ারের' ভূমিকায়। কিছুদিন পর প্রমোশন পেয়ে আইসিসির এলিট প্যানেলের সদস্যভুক্ত হন তিনি। দায়িত্ব পালন করেছেন ২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপেও। ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর ধরে তিনি ছিলেন আইসিসির এলিট প্যানেলভুক্ত আম্পায়ারদের একজন।
বিলি বাউডেন প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বমোট ৮৪টি টেস্ট, ২০০টি ওয়ানডে ও ২৪টি আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচ পরিচালনা করেছেন তিনি। টেস্ট ম্যাচ পরিচালনায় সংখ্যার দিক থেকে বাউডেন আম্পায়ারিং ইতিহাসে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ। আর ওয়ানডেতে 'অনফিল্ড' আম্পায়ার হিসেবে পরিচালিত ম্যাচসংখ্যায় তাঁর চেয়ে এগিয়ে আছেন শুধুমাত্র রুডি কোয়ের্তেজেন (২০৯)।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ওয়েলিংটনে চ্যাপেল-হ্যাডলি সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে শেষবারের মত দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় আম্পায়ার হিসেবে নেমেছিলেন ২০০তম ওয়ানডেতে। বিলি বাউডেন কি তখনো জানতেন সেটাই তাঁর শেষ! ওয়েলিংটনের সেই ম্যাচটাই হয়তো হয়ে থাকবে বাউডেনের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ! গত বছরের জুনে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের প্রকাশিত আম্পায়ারদের আন্তর্জাতিক প্যানেল থেকে বাদ পড়েছেন এই বিনোদনদায়ীআম্পায়ার। বাউডেনকে রাখা হয়েছে শুধুমাত্র ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচ পরিচালনার জন্য।
আম্পায়াররাও যে বিনোদন দিতে জানেন সেটা বিলি বাউডেনের উত্থানের আগে কোনভাবেই বোঝার উপায় ছিল না। ক্রিকেটার ও দর্শকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় এই আম্পায়ার বিখ্যাত ছিলেন ক্রিকেট মাঠে ব্যতিক্রমী ও মজার সব কাণ্ডকারখানার জন্য। প্রয়াত কিউই অধিনায়ক মার্টিন ক্রো একবার তাঁকে অভিহিত করেছিলেন 'দ্য ক্লাউন' নামে। বাঁকানো আঙুল তুলে আউট দেওয়া, অদ্ভুতুড়ে সব ভঙ্গিতে চার-ছক্কার সংকেতের পাশাপাশি নিউজিল্যান্ডের এই আম্পায়ারকে ক্রিকেট বিশ্ব মনে রাখবে আন্ডারআর্ম বোলিংয়ের জন্য গ্লেন ম্যাকগ্রাকে লাল কার্ড দেখানোর মতো মজার ঘটনাগুলোর কারণেও।
ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ারিং করাকে পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর একটি বললেও খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। মানুষ মাত্রই ভুল করে। আম্পায়াররাও কেউ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নন; কেননা তাঁরাও মানুষ। অন্যান্য আম্পায়ারদের মত বিলি বাউডেনও বিভিন্ন সময় অনেক ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন; এবং সেগুলোর জন্য সমালোচিতও হয়েছেন। তাতে হয়ত কারো কপাল পুড়েছে, কারও হয়ত খুলেছে। এসব খেলারই অংশ। এমনকি পাঁচ কিংবা সাত বলে ওভার দেয়ার মত 'শিশুতোষ' ভুলের ঘটনাও আছে তাঁর ক্যারিয়ারে। বাজে ডিসিশনের কারণে মাঝে মধ্যেই তাঁকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে নানা বিতর্ক। আসলে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে যতটা মনে রাখা হয়, দুর্দান্ত আম্পায়ারিংয়ের জন্য খুব কম লোকই মনে রাখেন। এটাই আম্পায়ারদের নিয়তি।
ক্রিকেট মাঠে বিলি বাউডেনের বর্ণময় উপস্থিতিটাই দর্শকদের জন্য সবসময় একটা মজার কিংবা বিনোদনের উপলক্ষ তৈরি করত। নিছক সেই মজার আড়ালেই হয়ত লুকিয়ে থাকত কতশত বেদনা, ত্যাগ কিংবা আক্ষেপের গল্প।
'দ্য মোস্ট এন্টারটেইনিং' আম্পায়ার খ্যাত বিলি বাউডেন এসেছিলেন থমথমে গোমড়ামুখো আম্পায়ারদের যুগে এক পশলা স্বস্তির নিঃশ্বাস হয়ে। শরীরে দুরারোগ্য আরথ্রাইটিস নিয়েই তিনি আজীবন নিঃস্বার্থভাবে ভালবেসে গেছেন ক্রিকেট খেলাটাকে। বিখ্যাত 'ক্রুকেড ফিঙ্গার অব ডুম' আউট সিগনালের জনক; যিনি নিজের শারীরিক প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে অপ্রথাগত আম্পায়ারিং দিয়ে ক্রিকেট মাঠে রেখে গেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর। তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।


VIDEO:

Comments

Popular posts from this blog

শাহরুখ খান কেন ‘ফ্লপ খান’?

কপিল শর্মা শোয়ের স্টার সুনিল গ্রভারের শোওতে!!!

স্তন ক্যান্সার ও সচেতনতা